বাংলা সাহিত্য ঈদুল ফিতর
আজহার মাহমুদ
ঈদুল ফিতর মুসলিমদের জন্য আনন্দের ও খুশির এক উৎসব। তাই ঈদ মুসলমানদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই গুরুত্বপূর্ণ দিনটিকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে নানান কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। অনেক বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক তাদের রচনায় ঈদের আনন্দ, ধর্মীয় আবহ এবং সামাজিক দিকগুলো তুলে ধরেছেন।
বাংলা সাহিত্যে ঈদুল ফিতর নিয়ে লেখালেখির সূচনা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। ঈদ নিয়ে প্রথম কবিতা রচনা করেন কবি সৈয়দ এমদাদ আলী (১৮৭৫-১৯৫৬)। তিনি বিখ্যাত ‘নবনূর’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং তার ‘ডালি’ কাব্যের জন্য পরিচিত। ১৯০৩ সালের নবনূর ডিসেম্বর সংখ্যায় ‘ঈদ’ নামে একটি কবিতা প্রকাশিত হয়, যা বাংলা ভাষার প্রথম ঈদ বিষয়ক কবিতা। কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি ছিল, “কুহেলি তিমির সরায়ে দূরে/তরুণ অরুণ উঠিছে ধীরে।” এই কবিতায় তিনি ঈদের প্রভাতের সৌন্দর্য এবং মুসলিম সমাজের ঐক্যের কথা তুলে ধরেছেন।
মহাকবি কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১) ‘ঈদ আবাহন’ নামে দুটি কবিতা রচনা করেন, যা ‘অশ্রুমালা’ এবং ‘অমিয়ধারা’ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত। এই কবিতাগুলোতে ঈদের আনন্দ এবং মুসলিম সমাজের মিলনের বার্তা প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, “আজি এ ঈদের দিনে হয়ে সব এক মন প্রাণ/জাগায় মোস্লেম সবে গাহ আজি মিলনের গান।”
বাংলা সাহিত্যে ঈদ বিষয়ক রচনায় কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) এক বিশেষ স্থান দখল করে রখেছেন। তার ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটি ঈদুল ফিতরের অন্যতম জনপ্রিয় সঙ্গীত। তিনি লিখেছেন, “ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ।” এই গানটি মুসলিম সমাজে ঈদের আনন্দ এবং আত্মত্যাগের মর্মার্থকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে।
শুধু এটাই নয়, নজরুলের ‘কৃষকের ঈদ’ কবিতায় গ্রামীণ কৃষকদের ঈদ উদযাপনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে দারুণভাবে। তিনি সেই কবিতায় লিখেছেন, “বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিমে আশমানে/খুশির তুফান উঠেছে রে মদিনা নগরী পানে।”
নজরুলের এই রচনাগুলোতে ঈদের আনন্দ, সামাজিক সাম্য এবং ধর্মীয় অনুভূতি গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। পাশাপাশি ঈদের সত্যিকারের যে আমেজ সেটা তিনি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন চমৎকারভাবে। আজও তার লেখা গান ঈদের আগের রাতে সবার ঘরে ঘরে বাজে।
ত্রিশের দশকের কবিরাও ঈদ নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। বেগম সুফিয়া কামালের ‘ঈদ’ কবিতায় ঈদের আনন্দ এবং মানব মনের শান্তির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি তার কবিতায় লিখেছেন, “আমার নিশীথের আধার সিন্ধু পাড়ি দিয়ে এল তরী/ফিরদৌস হতে সওগাত লয়ে গগন কিনার ভরি।”
কবি ফররুখ আহমদ তার ‘ঈদের স্বপ্ন’ কবিতায় ঈদের স্বপ্নময়তা এবং আনন্দের কথা তুলে ধরেছিলেন। তিনি লিখেছেন, “আকাশের বাঁক ঘুরে চাঁদ এলো ছবিত মতন/নতুন কিশতি বুঝি এলো ঘুরে অজানা সাগর।”
এছাড়াও আল মাহমুদ, আহসান হাবীব, সিকান্দার আবু জাফর, আবুল হোসেন, তালিম হোসেন প্রমুখ কবিরা তাদের লেখায় ঈদুল ফিতরের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন।
কবিতার পাশাপাশি গদ্য সাহিত্যেও ঈদুল ফিতর বিশেষ স্থান পেয়েছে। কাজী আবদুল ওদুদ এবং মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী তাদের প্রবন্ধে ঈদুল ফিতর নিয়ে নানা তথ্য তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে গল্প-উপন্যাসেও ঈদের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, সেলিনা হোসেনসহ অনেক সাহিত্যিক তাদের রচনায় ঈদের আবহকে ফুটিয়ে তুলেছেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর “রসগোল্লা” গল্পে ঈদের দিনে এক ব্যক্তির মনস্তাত্বিক পরিবর্তনের চিত্র চমৎকারভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে ঈদুল ফিতর ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। কবি-সাহিত্যিকরা ঈদের আনন্দ, মানবিকতা ও সাম্যের চিত্র তুলে ধরেছেন নিখুতভাবে। ঈদের বিষয়ভিত্তিক সাহিত্য ভবিষ্যতেও বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ স্থান দখল করে রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।